দ্রব্যমূল্যের মতো সুখের দাম বেড়ে যাওয়া সমাজে, একটি প্রেমের গল্প

দুই জনের বয়স সামান্য বেশি। ছেলেটার ২৮/২৯ আর মেয়েটার ২৪/২৫ হবে। দেখে মনেও হতে পারে স্বামী স্ত্রী, কিছুদিন আগে বোধহয় বিয়ে হয়েছে। তবে আমার মনে হলো তারা প্রেমিক প্রেমিকা। দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। ছেলেটার এক হাতে সিগারেট। মেয়ে যত কঠিন বা সোজাই হোক না কেন, প্রেমিকা অবস্থায় প্রেমিককে সিগারেট খেতে দেয়। বিয়ের পর স্ত্রীর পাশে সিগারেট ধরানোর সাহস স্বামীদের থাকে না। নতুন বিয়ে হলে তো আরো সম্ভব না।

স্মার্টফোনে সেলফি তোলার জন্য সামনেই একটা ক্যামেরা থাকে। কম দামী স্মার্ট ফোনের সামনের ক্যামেরার পিক্সেল কম। ছবি ভালো আসে না। আবার টাচ স্মার্ট ফোনগুলো এমন যে উল্টো করে ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলাও কঠিন। না দেখে আঙ্গুল দিয়ে ঠিক মাঝ বরাবর ক্যামেরার ক্লিক অপশনে চাপ দেয়া কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটাই করছিল মেয়েটা।

রাত ০৯ টা ২০। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চা ওয়ালা কাপ গুটাচ্ছেন, সিগারেটওয়ালা প্যাকেট ঝোলায় ভরছেন। আশেপাশে ভিড় কমছে। বাঁধানো গাছের গোঁড়ায় বসে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজন চায়ের কাপ হাতে সেলফি তোলার চেষ্টা করছেন।

ছেলেটার দিকে তাকালাম। পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল জাতীয় জুতা। খুব সাধারণ পোশাক। দাড়ি আছে হালকা, স্টাইলিশ না। কিন্তু শান্ত, সুস্থির। মেয়েটার পরনে সাধারণ থ্রি পিস। জুতাও মোটামুটি কম দামের। চটি জুতার মতো। কিন্তু ছেলেটার সাথে মেয়েটার মুখও শান্ত, সুস্থির। তৃপ্ত।

মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় মেয়েটা তিন চারবার ছবি তুলতে পারলো। ছবি তোলার সময় দুজনেই চায়ের কাপ তুলে ধরছেন। চায়ের কাপের স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টায় উল্টো করে ধরা স্মার্টফোন। ফ্ল্যাশ দিলো। কমদামী ফোনে যা হয়, ফ্ল্যাশেও খুব একটা উজ্জ্বল হলো না। দুজনেই মোবাইল ঘেঁটে ছবি দেখছে। কি আগ্রহ সহকারেই না দেখছে!

ছেলেটার ফোন বোধহয় আরো কমদামী। নিজের ফোন বের না করে প্রেমিকার ফোন হাতে তুলে নিলো সে। প্রেমিকার চেয়ে ভালো ছবি তুলবে এরকম একটা ভাব। আবারো উল্টো করে ধরা হলো ফোন। মেয়েটা কাপ সহ প্রেমিকের দিকে ঘেঁষে এলো একটু। কাপ উঁচু হলো, ফ্ল্যাশ দিলো। তেমন জোরালো হলো না।

ছবি দেখে মেয়েটা একটু মুচকি হাসলো। ছবি খুবই জঘন্য হয়েছে। তবে খুব বেশি হাসাহাসি করে পাশের মানুষটাকে কষ্ট দিতে চায় না বোধহয়। যা উঠেছে তারা তাতেই খুশি।

একটা আদর্শ প্রেমের জুটি বলতে যা বোঝায় তারা তাই। মেয়েটার মুখ শান্ত, শিষ্ট। গ্রামীণ ছায়া মুখে। দেখলেই কেমন যেন গ্রামের কথা মনে পড়ে। দুপুরের রোদে পুকুর পারে গাছের ছায়ায় বানানো টং এ বসে বাতাস খেতে যেমন ভালো লাগে, শরীর মন জুড়িয়ে যায় ঠিক তেমন একটা মুখ। মায়াকাড়া। পাশের মানুষটার জন্য নির্ভেজাল ভালোবাসা সেই চোখে মুখে।

ছেলেটার মুখটাও দেখার মতো। পাশের জনের জন্য উদগ্রীব। শীতল। চোখে মুখে, শরীরে ভরসা দেয়ার প্রতিজ্ঞা।

কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। দুজনের বসে থাকার ভঙ্গিই বলে দেয় চেহারা জুড়ে তৃপ্তি, ভালোবাসা আর পাশে থাকার আশ্বাস। দুজনেই সৌভাগ্যবান। এই জুটির জীবনে কখনো দুঃখ কষ্ট আসবে না। দুঃখ এলেও দুজনেই এভাবে পাশে থেকে মোকাবেলা করে যাবে। তাদের যে ভালোবাসা আছে আর ভালোবাসার মাঝে যে তৃপ্তি আছে দুজনের চেহারায় তাতে তাদের দামী স্মার্টফোনের দরকার হবে না কখনো। প্রেমিকের বাইক না থাকলে প্রেমিকা বলবে- বাইক ভালো না, এক্সিডেন্ট হয়। রিকশাভাড়া না থাকলে বলবে- আজকের আবহাওয়ায় ক্যান জানি হাঁটতে ভালো লাগছে। চলো না, রিকশা বাদ দিয়ে হাঁটি। বেশিদূর তো না..

সেলফি না, ইচ্ছে করলো তাদের একটা সুন্দর ছবি তুলে দিই, নিজের কাছে একটা রেখে দিই। এমন তৃপ্ত, প্রেমিক প্রেমিকা, নির্ভরতার গল্প সব সময় পাওয়া যায় না।

ইচ্ছেটা বাতিল করে দিলাম। কি দরকার! তারা তাদের কমদামী ফোনে উল্টো করে সেলফি তুলেই খুশি আছে। সেলফি হলো না হয় ঝাপসা। দুজনের একজন যে অন্যজনের, এটা তো আর ঝাপসা নয়। এই শো অফের প্রেমের যুগে তারা তাদের টানাপোড়ন নিয়েই সুখে আছে। প্রেম করে সুখী হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। কি পেলাম, কি না পেলাম, কি আছে কি নাই, এই হিসাব করতে বয়েই গেছে তাদের!

বয়ে যাওয়া স্রোতের ভিড়ে প্রতিদিন কতো কাপলই তো দেখি। হাঁটতে দেখি, রিকশায় দেখি, বাইকে দেখি, গাড়িতে দেখি কিন্তু কই, প্রেম করে এরকম তৃপ্ত মুখ তো কখনো দেখি না।

এইসব সো কলড কাপল আর দ্রব্যমূল্যের মতো সুখের দাম বেড়ে যাওয়া সমাজে এই জুটিটা বরং থাকুক তাদের মতো করে। প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে। সুখী হয়ে। বাঁচুক তৃপ্তি নিয়ে। স্মৃতি ধরে রাখুক কমদামী স্মার্টফোনে উল্টো করে তোলা ঝাপসা সেলফিতে…

– মোঃ ফেরদৌস রহমান

Categories: বিনোদন,লাইফ স্টাইল

ব্রেকিং নিউজ