যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে আগামীকাল শনিবার (১ জুন) দিবাগত রাতে সারা দেশে পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবে কদর পালিত হবে।
বিশ্ব মুসলিম মননে সর্বাধিক পবিত্র ও মহিমান্বিত রাত হচ্ছে লাইলাতুল কদর। এই মহান মর্যাদাময় রাত্রিতেই বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তির সনদ ও সর্বযুগের সর্ব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার অপরিবর্তনীয় বিধান গ্রন্থ আল-কোরআন নাজিল করা হয়েছিল।
‘শবে কদর’ কথাটি ফারসি। শব মানে রাত বা রজনী আর কদর মানে সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য ইত্যাদি। শবে কদর অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবে কদরের আরবি হলো লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। যে রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে, সে রাতই লাইলাতুল কদর।
আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা পর্যন্ত। (আল কোরআন, সুরা-৯৭ [২৫] আল কদর (মাক্কি), রুকু: ১/২২, আয়াত: ১-৫, মঞ্জিল: ৭, পারা: ৩০ আম্ম-সি পারা, পৃষ্ঠা ৬০৫/১৯)। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে কদর’ নামেই সমধিক পরিচিত।
এ রাতের বিরাট মাহাত্ম ও অপরিসীম মর্যাদার কারণে রাতটিকে ‘লাইলাতুল কদর’ তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির মেয়াদ ও পরিমাণ নির্দিষ্ট করে তা সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেওয়া হয়।
এ রজনী এত সম্মানিত যে, এক হাজার মাস ইবাদত করলেও যে সওয়াব হতে পারে তার চেয়ে লাইলাতুল কদরের ইবাদতে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। তাই এই রজনীকে পাওয়ার জন্য মন ও দেহের প্রস্তুতির দরকার রয়েছে। রমজানের শেষ দশক লাইলাতুল কদর তালাশের।
রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য ইবাদতের কথা বলেছেন। তাই শবেকদর পাওয়ার জন্য আমাদের সর্বচেষ্টা করা উচিত। মুমিন বান্দারা এই রাতটিকে পাওয়ার আশায় মুখিয়ে থাকেন। রমজানের শেষ দশকে তারা ইবাদতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। প্রথম দুই দশকের চেয়েও শেষ দশকে ইবাদতে মশগুল থাকেন বেশি করে।
লাইলাতুল কদরের ফজিলত অপরিসীম। তাই সারা রাত জাগরণ করে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা কর্তব্য। বেশি বেশি নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ, কাজা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সাদকা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইসতেগফার, দুয়া-দুরূদসহ নফল আমলের প্রতি মনযোগী হওয়া একান্ত জরুরি।
কোরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি একে নাযিল করেছি শবে কদরে। শবে কদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? শবে কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা আল কাদর : ১-৫)।
কদর নামকরণের কারণ: যেহেতু এ রজনী অত্যন্ত মহিমান্বিত ও সম্মানিত তাই এ রজনীকে লাইলাতুল কদর বলা হয়ে থাকে। আবার এ রাত্রে যেহেতু পরবর্তী এক বৎসরের অবধারিত বিধিলিপি ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় সে কারণেও এ রজনীকে কদরের রজনী বলা হয়।
সূরা কদর অবতীর্ণ হওয়ার পটভূমি: ইবনে আবি হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের সম্মুখে বনী ইসরাঈলের জনৈক চারজন লোক সম্পর্কে আলোচনা করলেন যে, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করে অধিককাল যাবত ইবাদত করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তারা একটিও নাফরমানি করেননি। রাসুলুল্লাহর (সা.) যবান মোবারক থেকে এ কথা শুনতে পেরে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং নিজেদের ব্যাপারে আফসোস করতে লাগলেন।
সাহাবায়ে কেরামের এ আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে মহান রাব্বুল আলামিন হজরত জিবরাঈলের (আ.) মাধ্যমে রাসুলের (সা.) নিকট এমন সময় এই সুরায়ে ‘কদর’ অবতীর্ণ করেন। (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন ও তাফসিরে মাজহারি)।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব: কদরের ফজিলত বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘কদর’ নামে আলাদা একটি সূরা অবতীর্ণ করেন। কেবল কোরআন নয় বরং হাদিসেও কদরের ফজিলত রয়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে।
কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরায়ে কদরে এরশাদ করেন-নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কোরআনুল কারীমকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। উক্ত রজনীতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাঈল (আ.) তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হন এটা শান্তিময় রজনী যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা আল কদর : ১-৫)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয় আমি তা (কোরআন) এক মোবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা আদ দুখান : ১-৪)।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (তাফসিরে মাজহারি)।
মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি, হাদিস নং : ৬৭২)।
লাইলাতুল কদর কবে: লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট কোনও তারিখ নেই। অনেকেই মনে করেন ২৭ রমজানই লাইলাতুল কদরের রাত। আসলে এ ধারণাটি সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনও বলেন নি যে, ২৭ রমজানের রাত কদরের রাত। তবে ২১ রমজান থেকে নিয়ে ২৯ রমজন পর্যন্ত বেজোড় যে কোন রাতই শবে কদর হতে পারে। লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতসমুহে তা খোঁজ করবে। (বুখারি, হাদিস নং :৭০৯)।
রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর। (মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬৯)।
একদা হযরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (সা.) কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন রমজানের বেজোড় শেষের দশ দিনের রাতগুলোকে তালাশ করো। (বুখারি, হাদিস নং: ২০১৭)।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রমজনের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে। (মুসলিম, হাদিস নং : ৮২৩)। তাই ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের রাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত রাসূল (সা.) বলেন, যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হল। আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন। (মুসলিম, হাদিস নং : ১১৬৭)।
শবে কদরে কী করব: রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ‘লাইলাতুল কদর’ লাভ করার জন্য রমজানের শেষ দশরাত জাগ্রত থেকে ইবাদতে কাটিয়েছেন এবং উম্মতে মুহাম্মাদীকেও সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসূল (সা.) বলেন, শবে কদরকে নির্দিষ্ট না করার কারণ হচ্ছে যাতে বান্দা কেবল একটি রাত জাগরণ ও কিয়াম করেই যেন ক্ষ্যান্ত না হয়ে যায় এবং সেই রাতের ফজিলতের উপর নির্ভর করে অন্য রাতের ইবাদত ত্যাগ করে না বসে। তাই বান্দার উচিত শেষ দশকের কোন রাতকেই কম গুরুত্ব না দেয়া এবং পুরোটাই ইবাদাতের মাধ্যমে শবে কদর অন্বেষণ করা।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম হে আল্লাহর রাসূল আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে আমি কি করব? তখন রাসূল (সা.) আমাকে এই দুয়া পাঠ করার জন্য বললেন। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’। (তিরমিজি, হাদিস নং : ৩৫১)।