বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড। সে এই হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। সে তার লোকজন নিয়ে স্ত্রীর সামনেই রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে। রিফাত শরীফ হত্যার কয়েকদিন পর নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। নয়ন বন্ডের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে গণমাধ্যমের কাছে। নয়নের উত্থানটাও ছিল অন্যান্য অপরাধীর মত বেশ চমকের। আর নয়নের উত্থানের পেছনে কাজ করেছে পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় প্রশ্রয়। নয়নের এক সময়ের সহপাঠীরা জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলে সুনাম দেবনাথ ও থানার কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার আশকারায় সাব্বির আহমেদ থেকে নয়ন বন্ড হয়ে উঠে সে।
নয়নের বন্ধুরা জানান, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর সাংসদপুত্র সুনাম দেবনাথ এবং তার চাচাতো শ্যালক শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ তালুকদারের সঙ্গে নয়নের সখ্য গড়ে ওঠে। অভিজিৎ ও নয়ন একসঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তখন বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া, চাঁদাবাজি ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেওয়া ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।
সুনাম দেবনাথ এর আশ্রয়ে ছিঁচকে চোর থেকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হয়ে উঠে নয়ন। মাদক, নারী, অবৈধ টাকা এসব নিয়েই থাকত সে। নিজের বাংলোয় (বিশেষ কক্ষ) ডেকে নিয়ে বহু তরুণীর সর্বনাশ করেছে নয়ন। নারীর পাশাপাশি মাদক নেশায়ও জড়িয়ে পড়েছিল নয়ন।
সন্ত্রাসের পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসারও গডফাদার ছিল সে। এসব অপরাধের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে এলাকার নেতৃত্বাস্থানীয়দের নজরে চলে আসে নয়ন। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে এলাকার রাজনৈতিক মহলের। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও নয়নের উঠাবসা ছিল চোখে পড়ার মত। নয়নের নিপীড়নের শিকার বহু নারীকে নিজের বাংলোয় পুলিশ কর্মকর্তাদের ভোগ করার সুযোগ করে দিত নয়ন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নয়ন বন্ড প্রথমে ছিঁচকে চোর ছিল। একপর্যায়ে মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ, মোবাইল ফোন নিয়ে দৌড় দিত। তবে নিষিদ্ধ মাদকের জগতে ঢুকে সে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। বছর খানেক ধরে জেলার প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে নয়নের ওঠাবসা শুরু হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
কলেজের সামনে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকত। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আটকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিত। না দিলে বেদম মারধর করত। কলেজের ছাত্রাবাসে যখন-তখন দলবল নিয়ে ঢুকে তাণ্ডব চালাত নয়ন বন্ড। কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে যাকে পছন্দ হত তার আর রেহাই ছিল না। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য সবকিছুই করত নয়ন।
নয়নের মা শাহিদা বেগম জানান, নয়ন ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিলেন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। তার বাবা ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। ২০০৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয় সে।
নয়নের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূর হোসেন জানান, বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। প্রেমে ছ্যাকা খাওয়ার পরই নয়ন গাঁজা সেবন শুরু করেন। ২০১১ সালে মাধ্যমিক পেরোনোর আগেই সে ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ে। তখন মাদকের টাকা জোগাতে মানুষের মুঠোফোন, গয়না ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ছিঁচকে অপরাধ শুরু করেন। এখান থেকেই নয়নের নষ্ট হওয়া শুরু।
মাদকের টাকার জন্য নয়নের এমন অপরাধ দিন দিন বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচটি মামলা হয়। ভুক্তভোগীরা তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে নয়নের বিষয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেন। নয়নও তখন রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজতে শুরু করেন। একপর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরাদ হোসেইনের হাত ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
নয়নের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর সুনাম দেবনাথ এবং তার চাচাতো শ্যালক শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ তালুকদারের সঙ্গে নয়নের সখ্য গড়ে ওঠে। অভিজিৎ ও নয়ন একসঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তখন বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়া, চাঁদাবাজি ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়া ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।তবে সুনাম দেবনাথ বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
বরগুনা শহরে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নয়ন বন্ডের ক্ষমতার উৎস শহরের কারও কাছেই অজানা নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশে নয়নকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে দেখা গেছে। বখাটে নয়নকে নষ্ট রাজনীতিতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন অসাধু রাজনীতিকরা।
হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘০০৭ লাইসেন্স’র নায়কের নামানুসারে নিজের নামের সঙ্গে ‘বন্ড’ যুক্ত করেন নয়ন। এর পর সিনেমাটির গল্পের আদলে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, এই ছবি দেখে নয়ন বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। এর পর নিজেকে ‘০০৭ লাইসেন্স’ সিনেমার নায়ক ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজের নামের সঙ্গে নিজেই যুক্ত করে দেন ‘বন্ড’ শব্দটি এবং একই সঙ্গে গড়ে তোলেন ০০৭ নামের সন্ত্রাসী বাহিনী। এই বাহিনী নয়নের হুকুমে চলত। তার নির্দেশমত অপকর্ম করে বেড়াত।
পুলিশের সঙ্গে ছিল নয়নের নিত্য উঠাবসা। শহরের বাসিন্দারা এমনও বলছেন, নয়ন চাইলে যে কাউকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি বা গ্রেফতার করাতে পারত। নয়ন কাজ করত পুলিশের বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবে।
সন্ত্রাসের পাশাপাশি নারী নেশায় বুঁদ ছিল নয়ন। নয়ন বন্ডের হাতে ঠিক কতজন তরুণীর সর্বনাশ হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই পুলিশের কাছেও। তবে নয়নের ‘বিশেষ কক্ষ’ থেকে উদ্ধার একটি ল্যাপটপে বহু পর্নো ভিডিও পাওয়া গেছে।
কয়েকটি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পর্নো ভিডিওতে নয়ন বন্ডের সঙ্গে একাধিক তরুণীর বিশেষ মহূর্তের দৃশ্য রয়েছে। একেক দিন একেক তরুণী নিয়ে সে যে ফুর্তিতে মেতে উঠেছিল তা স্পষ্ট।
পুলিশের সূত্র বলছে, নয়ন বন্ডের ওই বিশেষ কক্ষের গোপন জায়গায় সুকৌশলে আইপি ক্যামেরা (ইন্টারনেট ক্যামেরা) বসানো থাকত।
বিশেষ উদ্দেশে নয়ন বন্ড যাদের ওই কক্ষে আনতেন তারা কেউ ক্যামেরার অস্তিত্ব টের পেতেন না। একবার নয়নের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার পর ওই মেয়ের আর রক্ষা ছিল না।
ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বারবার কিশোরী- তরুণীদের ব্যবহার করত সে। অনেক তরুণী নয়নের হাত থেকে বাঁচতে কলেজ ছাড়তে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন।
সাব্বির আহমেদ নয়ন থেকে বনে যায় ‘নয়ন বন্ড’। শেষ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নয়ন বন্ডের অধ্যায়ের শেষ হয়। কিন্তু বরগুনায় আরও অনেক নয়ন রয়েছে, যারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাদের ছত্রছায়ায় সাব্বির আহমেদ নয়ন বন্ড হয়ে উঠেন তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন?